اَلْحَمْدُ لِلّٰهِ نَسْتَعِيْنُهُ وَ نَسْتَغْفِرُهُ وَ نَعُوْذُ بِهِ مِنْ شُرُوْرِ اَنْفُسِنَا وَ مِنْ سَيِّئَاتِ اَعْمَالِنَا ، مَنْ يَهْدِ هِ اللهُ فَلَا مُضِلَّ لَهُ وَ مَن يُضْلِلْهُ فَلَا هَادِيَ لَهُ وَاَشْهَدُ أَنْ لَّا اِلٰهَ الَّا اللهُ وَاَشْهَدُ أَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُه وَ رَسُوْلُهُ فَاَعُوْذُ بِاللهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيْمِ بِسْمِ اللهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيْمِ مَنْ عَمِلَ صَالِحًا مِنْذَكَرٍ اَوْ اُنْثٰى وَهُوَ مُؤْمِنٌ فَلَنُحْيِيَنَّه حَيَاةً طَيِّبًا وَ لَنَجْزِيَنَّهُمْ اَجْرَهُمْ بِاَ حْسَنِ مَا كَانُوْا يَعْمَلُوْنَ وَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلّٰى اللهُ عَلَيْهِ وَ سَلَّمَ يٰا اَيُّهَا النَّاسُ قُوْلُوْا لَا اِلٰهَ اِلَّا اللهُ تُفْلِحُوْنَ أَوْ كَمَا قَالَ عَلَيْهِ الصَّلَاةُ وَ السَّلَامُ
আল্লাহ তা’আলা যাকে তৌফিক দেন তার দ্বারা নেক আমল করিয়ে নেন। তৌফিক শব্দ অনেক কিছুই বুঝায়, তার মধ্যে প্রধান দুটো অংশ হল; যে আমল করছে তার পক্ষ থেকে ইচ্ছা এবং আগ্রহ, আর সে আমল করার সুযোগও। ফযরের নামাজ পড়ার ইচ্ছা, তো শুধু ইচ্ছায় হবে না, ফযরের ওয়াক্তও লাগবে। আমি দুপুর বেলা ইচ্ছা করলাম ফজরের নামাজ পড়ি, তো এই ইচ্ছা কোন কার্যকর করা যাবে না। কারন ঐটার জন্য ফজরের ওয়াক্তের প্রয়োজন। রোযার ইচ্ছা; তো রমযানের মাস লাগবে। ঈদের দিন রোযা রাখতে পারব না। তো আল্লাহ তা’আলা আমলের আদেশ দেন, আদেশ বান্দার কাছে আসে সে যেন এই আদেশ অনুযায়ী আমাল করার ব্যাপারে আগ্রহী হয়, তার মধ্যে আমলের জন্য ইচ্ছা জাগে। কিন্তু আমল করার জন্য আবার এর উপযুক্ত অবস্থারও প্রয়োজন। যেমন নিয়ত করল ফজরের নামাজ পড়ব, তো ফজরের ওয়াক্ত হতে হবে। নিয়ত করল আমি সবর করব, সবরের পরিস্থিতি হতে হবে। সবরের ফাযায়েল খুব সুন্দর, বয়ানের মধ্যে, কথার মধ্যে, কোরআন শরীফের মধ্যে। কোরআন শরীফে সবরের ব্যাপারে বড় বড় আয়াত আছে-
اِنَّ اللهَ مَعَ الصَّابِرِيْنَ
‘আল্লাহ সবরওয়ালাদের সঙ্গী হন’
সঙ্গী হওয়া মানে বহুত বড় ব্যাপার। তো কেউ নিয়ত করল যে আমি সবর করব, কিন্তু সবরের জন্য সবরের অবস্থা দরকার। তার খুব ভাল স্বাস্থ্য, খাওয়ারও খুব রুচি আছে, বাদশাহ তাকে হাদিয়া পাঠালো এক বাক্স মিষ্টি; তো বাদশাহের দূতের কাছে এই মিষ্টি পেয়ে তার খেতে খুব রুচি হল। তো স্বাস্থ্যও ভাল, মিষ্টিও ভাল এবং বাদশার পাঠানো; মান-সম্মান। সে মিষ্টির বাক্স নিয়ে এই কথা বলবে নাকি যে ‘আমি আল্লাহর ওয়াস্তে সবর করলাম’? কারন এটা শুকুরের অবস্থা, শুকুর করবে যে আল্লাহ তা’আলা ভাল স্বাস্থ্য দিয়েছেন, ভাল মিষ্টিও দিয়েছেন, আবার বাদশাহের কাছে সম্মানও দিয়েছেন। এজন্য আল্লাহর কাছে আমি শুকুর আদায় করি- সেটা অন্য আমল কিন্তু সবর তো করতে পারবনা। এক্ষেত্রে সবরের তো সুযোগ নেই।
তো আল্লাহ তা’আলা আমলের সুযোগ দিয়েছেন; কিছু সুযোগ আছে আমভাবে সবার জন্যে আসে। ফজরের ওয়াক্ত হলো; তো ফজরের নামাজ পড়ার সুযোগ ঐ গোটা গ্রামের লোকের জন্যই। এখন যে গ্রহন করল সে ফজরের নামজ পড়ল, যে গ্রহন করল না তার হাতছাড়া হয়ে গেল। যে সুযোগ গেল ঐ সুযোগ শেষ। তো এরকম সব সুযোগ গুলোই সীমিত অবস্থার থাকে। রমযান শেষ- এখন রমযানের যত ফাযায়েল ছিল ঐ সুযোগ গুলোও শেষ, ঈদের চাঁদ ওঠার সাথে সাথে। এর আগে পর্যন্ত ছিল। ঐটা ওখানকার সবার জন্য।
আবার কিছু কিছু জিনিস আছে যেগুলো সবার জন্যে নয়, খাস । সবর; একই বাড়ীতে পাঁচ জন সুস্থ, এক জন অসুস্থ। অসুস্থতায় খুব কষ্ট লাগছে, কিন্তু সে সবর করছে। তো একই বাড়িতে যদিও, কিন্তু সবরের সুযোগ পাঁচ জন পাচ্ছে না। বাকি পাঁচ জন ওদের হয়তো ইচ্ছা আছে- আমি আল্লাহর ওয়াস্তে সবর করব, কিন্তু সে তো অসুস্থ নয়, কিসের উপর সবর করবে?
আল্লাহওয়ালারা অভাবের উপর সবর করেন। কিন্তু যে নিয়ত করলো আল্লাহওয়ালাদের মতো অভাবের উপর সবর করব, কিন্তু তার অভাব নাই, তো সবর করবে কেমন করে? এগুলো খুসুসি। ফজরের ওয়াক্ত, রমযানের মাস- এগুলো সবার, আর রোগ-ব্যধি, কষ্ট, অভাব এগুলো খুসুসি। কিন্তু খুসুসি হোক আর উমুমি হোক, আল্লাহ তা’আলা পালাক্রমে সবাইকে সাধারণত সুযোগ দিয়ে থাকেন। সবগুলো সবার জন্য আসে না কিন্তু অনেক সময় আসে। কখনো কখনো বহুত বড় সুযোগ আসে।
اِنَّ مِرَّبِّكُم فِدَّهرِ نَفَحَاتِ فَتَعرِدُونَهَا
তোমাদের রবের পক্ষ থেকে তোমাদের জন্যে نَفَحَاتِ থাকে, যেরকম বলে দমকা বাতাস; হঠাৎ করে একটা বাতাস এলো আবার চলে যায়, কিছুক্ষন পরে নাই। ওরকম হঠাৎ করে অনেক গুলো সুযোগ থাকে, আর যখন এরকম সুযোগ আসে, নিজেকে তার জন্য পেশ করা।
তো নৌকা চলছে, আগের জমানায় পালের নৌকা চলত, শুধু পাল থাকলে তো হবে না বাতাস লাগবে। বাতাস যদি না থাকে তো পাল ধরেও কাজ হবে না। পাল ঝুলে আছে নৌকাতে টান নাই, হঠাৎ করে একটা জোর বাতাস এল আর কিছুক্ষণের মধ্যে নৌকাকে একেবারে পাড় পর্যন্ত পৌঁছে দিল। কিন্তু ঐসময় তার ঠিকমত পাল ধরা জানতে হবে। গাফলতি করে পাল গুটিয়ে রেখেছে, বাতাস এসে চলে গেল, তার পাল টানানো হলই না। তো ওরকম আল্লাহর তরফ থেকে সুযোগ আসে, সুযোগের সময় যদি আগে থেকে প্রস্তুত থাকে, নিয়ত থাকে, আর সুযোগকে একটা সুযোগ হিসেবে গ্রহন করে তাহলে ওখান থেকে বড় ফায়দা হবে। কিন্তু তার মধ্যে ঐ আগ্রহ এবং তলব থাকতে হবে- আল্লাহ তুমি আমাকে সুযোগ দাও।
ওহুদের আগে সা’দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস রাযিআল্লাহু আনহু আর আব্দুল্লাহ ইবনে জাহশ রাযিআল্লাহু আনহু দুজন দু’আ করছেন। সা’দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস রাযিআল্লাহু আনহু এই দু’আ করলেন “আয় আল্লাহ, আগামী দিন জিহাদে কাফিরের একজন বাহাদুরের সাথে আমার মোকাবিলা করাও, সে যেন শক্তিশালী, সাহসী হয়, আমার উপর যেন জোর আক্রমণ করে, আমিও তার উপর জোর আক্রমণ করি, আর তারপর আমি যেন তার উপর বিজয়ী হয়ে যাই”। দুজনেই আমীন বললেন। এখানে দুটো জিনিস আছে, সা’দ রাযিআল্লাহু আনহুর নিজের পক্ষ থেকে জিহাদের আগ্রহ, কিন্তু অপর দিক থেকে একটা সুযোগও, সেও যেন একজন বাহাদুর, জোর আক্রমণ করতে পারে। ঐটা নিজ হাতে নাই। এমনও হতে পারে যে তাঁর মোকাবেলায় যে এল সে বেচারা প্যারালাইসিস রোগী, তলোয়ার ঠিকমত ধরতে পারে না। তো হাত-পা নাড়াতে নাড়াতেই শেষ। তো উনি নিয়ত করলেন ঠিকই জোর যুদ্ধ করবেন, কিন্তু উনার মোকাবেলা পড়ে গেলো প্যারালাইসিস রোগীর সাথে, উনার যত হিম্মত ছিল, হিম্মত তো কোন কাজে লাগবে না। আর তারপর ঐ প্যারালাইসিস রোগীকে যদি উনি কতল করেও আসেন, এসে বলতেও লজ্জা লাগবে যে আমি জবরদস্ত হিম্মতের সাথে এক প্যারালাইসিস ওয়ালাকে কতল করে এসেছি! যদিও, বাহাদুর পেলেও কতল করতেন। কিন্তু ‘করতেন’ ঐ কথাতো শুধু আল্লাহ জানেন, মনের ভিতরের কথা। আর বাইরে তো ঐটাই, লোকে হাসবে, দেখ সা’দের কথা! তো লজ্জা করবে, অনেক সময় বেরোতেই চাইবে না, কারন সবাই জিজ্ঞেস করবে তুমি কার সাথে মোকাবেলা করেছ? আর উনি যদি বলেন যে এক প্যারালাইসিস ওয়ালার সাথে মোকাবেলা করলাম! বলতেও লজ্জার ব্যাপার।
তো উনি নিজের তরফ থেকে আগ্রহও পেশ করছেন যে আমি যেন জোর হামলা করি, কিন্তু আল্লাহর পক্ষ থেকে সুযোগও চাচ্ছেন, ঐটা তুমি করে দাও যে আমাকে যেন বড় বাহাদুর আক্রমণ করে।
আব্দুল্লাহ ইবনে জাহশ রাযিআল্লাহু আনহু দু’আ করলেন প্রায় একই ধরনের যে, সে যেন একজন বাহাদুর থাকে, আমার উপর যেন জোর আক্রমণ করে, আমিও তার উপর জোর আক্রমণ করি আর সে যেন আমাকে কতল করে। এটাও আগ্রহ এবং সুযোগ দুটোই আছে। আমার আগ্রহ আমি যেন শহীদ হই কিন্তু আমি হাত পা গুটিয়ে রাখলাম, তলোয়ার চালালাম না আর সে আমাকে কতল করে ফেললো- ঐটা শরীয়ত এজাজত দেয় না। যেহেতু আমি যুদ্ধের ময়দানে গিয়েছি, আমাকে আমার শক্তি সামর্থ্য মতো পুরা লড়তে হবে। শহীদ হওয়ার জন্যে আমি তলোয়ার গুটিয়ে দিলাম, ঐটা জায়েজ নয়; পুরো লড়তে হবে।
তো আমি যখন আমার সম্পূর্ণ শক্তি দিয়ে লড়েছি, এরপরেও শহীদ হতে পারলাম না, ঐটাতো আমার হাতে নাই, আল্লাহ যদি করে দেন। ঐটা আল্লাহর কাছে চাচ্ছেন যে আল্লাহ তুমি এটা করে দাও, আমি তো লড়বোই, পুরা জোরেই লড়ব কিন্তু তুমি আমাকে ওরকম করে দাও। আর তারপর যেন আমার নাক কান এগুলোও কেটে ফেলে। এগুলোতো মরার পরে, শহীদ হয়ে যাওয়ার পরে তারপর নাক কান কেটে ফেলে। এটাও তো, নাক কান নিজ তো আর কাটবেন না, উনি নিজে তো শহীদ হয়েই গেছেন, শত্রু যেন এগুলো করে। কিছু আমার তরফ থেকে আগ্রহ, আর কিছু আল্লাহর কাছে চাওয়া, আয় আল্লাহ তুমি আমার এই অবস্থাগুলো করে দাও। এ সব মিলে তৌফিক, আমরা যে বলি আল্লাহ যেন তৌফিক দেয়।
হজ্বে যাব। তো হজ্বে যাওয়ার জন্য আমার আগ্রহ হল, কিন্তু হজ্বের মৌসুমও তো চাই। শুধু আমার ইচ্ছাতে তো আর হজ্ব হবে না। আল্লাহ যদি হজ্বের মৌসুম না দেন তাহলে আমার আগ্রহ দিয়ে আমি একা হজ্ব করতে পারবো না। মক্কা মদিনা সব ঘুরে এলাম কিন্তু হজ্ব তো হবে না। ঐ আরাফাতের দিন লাগবে।
আল্লাহ তা’আলা বিশেষ বিশেষ হালাত বান্দার উপর নাযিল করেন, আর যারা এখান থেকে সুযোগ নিয়ে নেয় তো অল্পতেই বহুত দূর অগ্রসর হয়ে যায়।
উমার রাযিআল্লাহু আনহু বললেন যে, আবু বকরের এক রাত আর এক দিন….। এক হল যখন হিযরত করেছেন, এই সুযোগ আবু বকর রাযিআল্লাহু আনহু পেয়েছেন, সবাই পান নি। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হিযরতের সঙ্গী আবু বকর সিদ্দীক রাযিআল্লাহু আনহুই ছিলেন। পেছনে তার ইতিহাস আছে, খামোখাই উনাকে সঙ্গী বানানো হয় নি, সে প্রস্তুতি দেখে বানানো হয়েছে। আর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যেদিন ওফাত হয়েছে সেদিন উনার মজবুতি; তো সেটাও সবার জন্য নয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওফাত সারা জীবন হয় না। আমি বললাম যে, ‘আমিও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওফাতের দিন খুব মজবুত থাকবো’! কবে তুমি মজবুত থাকবে অপেক্ষা কর! এজন্য তো ঐ সুযোগের প্রয়োজন, ঐটাতো চলে গেছে।
সাহাবারা যে দ্বীনের বহুত উপরের দরজায় পৌঁছেছেন তার প্রধান রাস্তা ছিল সবর।
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُواْ اصْبِرُواْ وَصَابِرُواْ وَرَابِطُواْ وَاتَّقُواْ اللّهَ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ
এই সবরের ভিতর দিয়ে সাহাবাদের তরবিয়ত হয়েছে। সবর বলতে আমরা শুধু মনে করি যে কেউ মারল আর আমি কান্নাকাটি করলাম না, হা-হুতাশ করলাম না, এটা আসল সবর নয়। আসল সবর হল নিজের মাকসাদের উপর অটল থাকা।
জিহাদের ময়দানে গেলাম, তো আমি আমার যে কাজ করছি, আমার হাতটা ভেঙ্গে যাওয়াতেও আমি থামছি না। হাত কেটে ফেলেছে, ঐ কাটা হাত ঝুলছে, তো ঐটা নিয়েও উনি লড়াই ছাড়ছেন না। আমরা একটা আঙ্গুল যদি কেটে যায় ঐটা নিয়েই ব্যস্ত হয়ে যাব আর কাটা হাত নিয়ে!
মুস’আব ইবনে উমায়ের রাযিআল্লাহু আনহু পতাকা ধরে ছিলেন, ঝান্ডা ধরে ছিলেন, হাত এইটুকু কেটে ফেললো, অন্য হাত দিয়ে ধরলেন। আমাদের জন্য চিন্তা করাই মুশকিল! হাত যদি কেটে ফেলে তো হুশ তো ঐদিকেই চলে যাবে, কোথায় ফ্ল্যাগ আর কোথায় কী! তো হাত কেটে ফেললো কিন্তু হাতের দিকে খেয়াল নয়, ঝান্ডা- ঐটা যেন না পড়ে। নিজের মনের, ধ্যানের কত মজবুতি! মানে যে কাজ আছে ঐ কাজের মধ্যে এত নিজেকে লাগিয়েছেন…!
খলিল আহমাদ সাহারানপুরী রহমাতুল্লাহি আলাইহি বজলুল মাযহুদ কিতাব লিখলেন। তাঁর সাথে ছিলেন মাওলানা জাকারিয়া রহমাতুল্লাহি আলাইহি। তারপর সেই বই ছাপানো হয়েছে ছাপাখানায়। সেই ছাপাখানা ছিল সম্ভবত থানাভবনে, হযরত মাওলানা থানভী রহমাতুল্লাহি আলাইহি এর বাড়ির ধারে কাছে। তো মাওলানা যাকারিয়া রহমাতুল্লাহি আলাইহি ওখানে আসতেন আর এই কিতাব নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন, এটা ছাপানো তারপর প্রুফ দেখা যেন শুদ্ধ হচ্ছে কিনা ইত্যাদি। ওখানে থানভী রহমাতুল্লাহি আলাইহির খানকা, উনার ওখানে উলামারা আসছেন যাচ্ছেন, থানভী রহমাতুল্লাহি আলাইহি বয়ান করছেন, কিন্তু যাকারিয়া রহমাতুল্লাহি আলাইহি এদিকে উকিও দিতেন না, তাকাতেনও না। উনি এসে উনার কাজের মধ্যে ব্যস্ত থাকতেন। থানভী রহমাতুল্লাহি আলাইহি এটা লক্ষ্য করতেন যে এদিকে এসে আমার দিকে তাকায়ও না, একটু সালাম তো করে যাবে! তাও নয়, কাজ নিয়ে ব্যস্ত। কিন্তু এই যে ধরেছেন আমার দিকে আসছেও না, কথাও শুনছে না, থানভী রহমাতুল্লাহি আলাইহি এটাকে বহুত প্রশংসার সুরে বলেছেন, ‘ওর প্রতি আমার ঈর্ষা হয় যে একটা কাজকে কত গুরুত্তের সাথে নিতে পারে’!
থানভী রহমাতুল্লাহি আলাইহি কে উনি বহুত বড় মুরব্বী মানতেন। তাঁদের কাছে মুরব্বী, আল্লাহ ওয়ালার বড় কদর। কিন্তু উনি উনার ঐ কাজে গেছেন, আর ঐ কাজে গিয়ে কদরের কারনে গিয়ে একটু সালাম করে আসি- তাও নয়। তো নিজের যে ফায়সালা ওটার উপর মজবুত।
একবার হুসাইন আহমাদ মাদানী রহমাতুল্লাহি আলাইহি আসবেন, তাঁর এস্তেকবালে গেছেন মাওলানা যাকারিয়া রহমাতুল্লাহি আলাইহি সহ অন্যান্যরা। মাওলানা যাকারিয়া রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেছেন যে, কেউ মোসাফাহা করতে যাবে না। কারন এত লম্বা লাইন, এতে সময়ও খরচ আর হাত দিয়ে চাপ দেয়। কখনো কখনো আমার নিজেরও মোসাফার সময় এত মোহাব্বতের সাথে ধরে দেয় চাপ! মান-ইজ্জত রক্ষার কারনে চিৎকারও করতে পারি না! তো যাই হোক, মাওলানা যাকারিয়া রহমাতুল্লাহি আলাইহি বললেন, কেউ মোসাফা করবে না। উনি সামনে, মাদানী রহমাতুল্লাহি আলাইহি ট্রেন থেকে নেমেই হাত বাড়িয়েছেন মোসাফা করার জন্য। হাত তো সামনের দিকে ছিল, মোসাফার জন্য যখন মাদানী রহমাতুল্লাহি আলাইহি হাত বাড়িয়েছেন উনি হাত পেছন দিকে নিয়ে গেছেন। মাদানী রহমাতুল্লাহি আলাইহি হুশিয়ার মানুষ, বুঝতে পেরেছেন বোধহয়, পেছন থেকে হাত টেনে এনে মোসাফা করেছেন। এরকম নয় যে একটা কথা বললাম আর আমার সামনে যেহেতু পড়েছে তো হাত বাড়াই আর এই সুযোগে মোসাফা করে নিই। উসুল বানিয়েছেন আর ঐটার উপর নিজে সবচেয়ে বেশী মজবুত, ‘আমি মোসাফা করবো না’।
তো কাজের মধ্যে, মেহনতের মধ্যে নিজেকে আগে রাখা। তো সাহাবারা, এক সবর হল যে মারের সবর। পরবর্তীতে আল্লাহ তা’আলা আবার দিলেন সম্মান, প্রাচুর্য। তখনকার সবর কী? লাখো লাখো টাকা, কোটি কোটি টাকা বিলাচ্ছেন কিন্তু নিজের খাওয়া আগের মতোই। এটা আরেক কঠিন জিনিস। খাবার নাই- সবর করলাম, বড় সহজ ব্যাপার। কিন্তু এত থাকার পরেও আমি আমার আগের উসুলের উপরেই আছি সবরের সাথে আর অন্যদের দিচ্ছি। আর শুধু দিচ্ছি না, তারা যদি বলে আপনি খান, তখন আমাদের কাছে যুক্তি হল, মেহমানের একরামের কারনে একটু খাওয়া উচিৎ, নইলে মেহমান মন খারাপ করবে! আর মনে মনে এ কথা যে আমার পেটও ভরবে। তো মেহমানের একরামের কারনে খুব খেতে আরম্ভ করলাম! কিন্তু অটল।
এর চেয়ে কঠিন হল, এই যে বাহ্যিক অবস্থা এত ভাল, এই ভাল অবস্থায় মনের অবস্থার মধ্যে একটু অহংকার আসা, ফূর্তি আসা, বেপরোয়া ভাব আসা- তা নয়। ঐ বিপদের সময় যেরকম চোখের পানি, প্রাচুর্যের সময়, সহোলতের সময়ও চোখের পানি। এটা সবচেয়ে কঠিন জিনিস।
আমাদের সাথীরা বলছিল, জামাত চলতে গিয়ে মার-টার খাওয়ার পরে হাত তুললেই ঝর ঝর করে চোখে পানি আসে। খুব সহজেই আসে। কিন্তু ঐ অবস্থা কেটে যাওয়ার পরে আর আসে না। কিন্তু ঐটাকে যদি আমি স্থায়ী বানাতে পারি, মজবুতভাবে ধরতে পারি, তাহলে ঐ অবস্থা কেটে যাবে কিন্তু আল্লাহর সাথে আমার যে সম্পর্ক হয়েছে, আমার মনের যে প্রস্তুতি হয়েছে ঐটা স্থায়ী রয়ে যাবে। আর রয়ে গেলেই তো ঐটা স্থায়ী জিনিস হয়ে যাবে। ঐ সবর আরো কঠিন। কঠিন অবস্থায়, কষ্টের অবস্থায় মনের যে অবস্থা, আরামের অবস্থায় সেই অবস্থাকে টিকিয়ে রাখা। এজন্য আল্লাহর কাছে তৌফিক চাওয়া, ইচ্ছা করলেই যে পারবে তা নয়, আল্লাহর কাছে চাওয়া। ঐটা যদি করতে পারে, তো বিশেষ অবস্থা মানুষের যে হয় ওগুলোকে ‘হাল’ বলে। আর হালের পরে হয় ‘মাকাম’। মাকাম কী? যা স্থায়ী, স্থায়ীভাবে রয়ে গেল।
খুব বড় বংশের, বড় আকর্ষণীয়, বড় সুন্দরী এক মেয়ের সাথে পরিচয় হল। আর সেই মেয়েও তার প্রতি খুব আগ্রহ প্রকাশ করছে নানানভাবে। একেবারে অপ্রত্যাশিত, অজানা কোন এক জায়গায়, কোন সফরে বা ট্রেনে বা প্লেনে বা কিছু একটা। তো কিছুক্ষন একটা অস্বাভাবিক অবস্থার মধ্যে থাকলো, অপ্রত্যাশিত। সফর শেষ হয়ে যাওয়ার পর কোথায় চলে গেলো কোন পাত্তা নাই। তো ঐটা হল ‘হাল’ জাতীয় জিনিস, সাময়িক। এর পরে আর ওর কোন পাত্তা খুজে পাওয়াও যাবে না। খুঁজে বের করি? খুঁজে বের করার ঠিকানা নাই, ফোন নাম্বারও নাই। হারিয়ে গেছে।
আর ঐ সময়ই কিছু অগ্রগতি হল, বিয়েই করে ফেললো। তো বিয়ে করার পরে তো ঐটা পার্মানেন্ট হয়ে গেলো। তখন ‘মাকাম’ এ চলে গেল। আর মাকাম হয়ে যাওয়ার পরে ঐটা আর বাহ্যিক প্রকাশ থাকে না। যতদিন পর্যন্ত বিয়ে হয় নি ততদিন পর্যন্ত মোহাব্বতের ঢেউ দেখা যায়! আর বিয়ে হয়ে গেলে অনেক সময় যেন বেলুনের সব বাতাস বের হয়ে গেল। সব সময় যে মোহাব্বত নষ্ট হয়ে গেছে তাও নয়। অনেক সময় থাকে, বাড়েও, কিন্তু বাহ্যিক প্রকাশ অন্য ধরনের হয়ে যায়। কারন একেক মোহাব্বত একেক ভাবে প্রকাশ পায়। বাচ্চাকেও ভালবাসে আর বাপকেও ভালবাসে। বাপের প্রতি ভালবাসার প্রকাশ আর বাচ্চার প্রতি ভালবাসার প্রকাশের ধরণ এক নয়।
তো একটা অবস্থায় পড়লাম আর আল্লাহর কাছে দু’আ করলাম। মনে একটা অবস্থা, আল্লাহকে ঘনিষ্ঠ মনে হচ্ছে। আল্লাহর কাছে চাচ্ছি, পাচ্ছি অনুভব হচ্ছে। এটা হল ‘হাল’। কিন্তু ঐটা যদি আমি আমার স্থায়ীভাবে নিজের একটা জিনিস অর্জন হয়ে যেতে পারে তো ঐটা হল ‘মাকাম’।
তো সাহাবীরা কষ্টের ভিতর দিয়ে ঐ অবস্থা প্রথমে হাল হিসেবে পেয়েছেন, কিন্তু পরে আস্তে আস্তে, ধীরে ধীরে গিয়ে ঐটা মাকাম হয়ে গেছে। মাকাম হয়ে যাওয়ার পরে আর চোখের পানি ফেলবার জন্য ঐ কাফিরের আক্রমনের দরকার ছিল না, আর পেটের ক্ষুধাও দরকার ছিল না। প্রথমে ক্ষুধা ছাড়া চোখের পানি পড়ে নি, বিপদ ছাড়া চোখের পানি পড়ে নি, কাফিরের আক্রমণ ছাড়া চোখের পানি পড়ে নি। কিন্তু চোখের পানির উপর নিজের যখন নিয়ন্ত্রন এসে গেছে, এরপরে ঐ রাজসিংহাসনে বসেও চোখের পানি পড়ছে। তখন আক্রমণেরও দরকার নয়, ক্ষুধারও দরকার নয়। আল্লাহ তা’আলা ঐটাকে মুস্তাকিল করে দিয়েছেন। কিন্তু ঐগুলো ছিল সিঁড়ি, ঐ সিঁড়ি দিয়ে উঠেছেন। আর এগুলো সিঁড়ি দিয়ে এত দ্রুত তরক্কি করা যায়, আল্লাহর বান্দারা যেকোন জমানায় করেছেন যে তার কোন তুলনা হয় না। ঈমান আনার পরেই এক ধাপে কোথায় পৌছে গেছেন! কিছুক্ষণের মধ্যেই।
এজন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে বিরাট তৌফিক, আল্লাহ তা’আলা বহুত বড় মেহেরবানি করে এই জমানায় আমাদেরকে দ্বীনের পথে কিছু কষ্ট বরদাশত করার তৌফিক দিয়েছেন। তৌফিকের বড় একটা অংশ আমরা বাইরে থেকে শুনি। দ্বীনের নামে মানুষের কাছে ধাক্কা খাওয়া, মার খাওয়া, লাঞ্ছিত হওয়া, অপদস্ত হওয়া- পরবর্তীকালে এগুলো বিরল জিনিস, নাই’ই। তাবলীগের প্রথম দিকে ছিল তাও অল্পস্বল্প। মাওলানা পালনপুরি রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলছিলেন যে, “আমরা ডান্ডা খেতাম আর তোমরা এখন আন্ডা খাও”।
আমরা যেভাবে তাবলীগকে দেখেছি, আন্ডা ছাড়া অন্য কোন সুরতই নাই, দেশে হোক আর বিদেশে হোক। আর জামাত গুলো তো বিদেশেও যায়, বিদেশ থেকে এসে কারগুজারি শোনায়, নিশ্চয় কেউ এই মজমাতে আছ কারগুজারি শুনেছ বিদেশি জামাতের। কী কারগুজারি? ‘সুবহানাল্লাহ! তের খানা মারসিডিস গাড়ি ছিল এয়ারপোর্টে! কে কোন গাড়িতে উঠবে ঐটারই ঠিক নাই, আমাকে এই গাড়িতে নেয়, ঐ গাড়িতে টানে এখন কোনটায় উঠবো’! এই হল কারগুজারি। অন্য ধরনের কিছু কারগুজারি যে হতে পারে এটা কারো কোন খেয়ালের মধ্যেই নাই! আল্লাহর মেহেরবানি, আল্লাহ তা’আলা অন্য ধরনের কিছু কারগুজারি দেখাচ্ছেন। এটা শুকুরের সাথে গ্রহন করা, আক্ষেপের সাথে না। শুকুরের সাথে। পার্থক্য এটা, যদি আমার কাছে এটার কদর থাকে, যার হাত দিয়ে আমি পেয়েছি তার কাছে আমি শুকুর করবো। আর দুনিয়াবি পলিটিশিয়ানের মত যদি থাকে তাহলে বাকি জীবন প্রতিশোধের চিন্তা করবে। এটাই আল্লাহওয়ালাদের মধ্যে আর দুনিয়া ওয়ালাদের মধ্যে পার্থক্য।
আবু বকর সিদ্দীক রাযিআল্লাহু আনহুর ছেলে শহীদ হয়েছেন; যিনি তীর নিক্ষেপ করেছেন, যার তীরে শহীদ হয়েছেন তাকে আবু বকর সিদ্দীক রাযিআল্লাহু আনহু পেয়েছেন। প্রথমে চিনতে পারেন নি, পরিচয় পেলেন, এই তীর যখন দেখালেন, যে তীরে উনার ছেলে মারা গেছে। উনি বললেন, “এই তীর আমি বানিয়েছি, এই তীরকে আমি ধার দিয়েছি, এই তীরের পেছনে আমি পালক লাগিয়েছি আর এই তীর আমি’ই নিক্ষেপ করেছি”। আবু বকর সিদ্দীক রাযিআল্লাহু আনহুর উত্তর কী? “সব তা’রিফ ঐ আল্লাহর যিনি তোমার হাতে আমার ছেলেকে সম্মান দান করেছেন, আর আমার ছেলের হাতে তোমাকে লাঞ্ছিত করেন নি”। দুই শুকুর, এক হল যে তোমার দ্বারা আমার ছেলে এতবড় মর্যাদা পেয়েছে, আর আরেক শুকুর হল যে, তুমিও ক্ষতিগ্রস্থ হওনি বরং লাভবান হয়েছ। সেদিন যদি তার বিপরীত ঘটনা ঘটতো, অর্থাৎ আমার ছেলের হাতে তুমি মারা যেতে তাহলে আমার ছেলে শহীদ হত না, আর তুমি কাফির মারা যেতে, হামেশা জাহান্নামে। তো দুই লাভ হল।
আজকে এখানে একজন যাওয়ার সময় সে তার কার্ড দিয়ে গেল, কার্ড দিল মানে হচ্ছে যোগাযোগ করতে চায়। দেখে শরফ চিনলো, কাকরাইলে মারামারির মধ্যে ছিল, গাল দিয়েছে, মার দিয়েছে। এখন আবার কিছু কথা শুনেছে, তারপর যাওয়ার সময় চুপচাপ একটা কার্ড দিয়ে গেল। কার্ড দিয়ে গেল মানে হল এইটা, যে একটু যেন তাকে ডাকি, যোগাযোগ করি কিছু একটা। নিশ্চয় মনের মধ্যে বিরাট পরিবর্তন। গতকালকে আমাদের এক সাথি গিয়েছিল একটা মসজিদে, ঐ মসজিদের জিম্মাদার মোটামুটি ধনী, স্বচ্ছল ব্যক্তি। উনার দেখা সাক্ষাতে আমরা এসেছিলাম। গতকালকে যখন কথা হচ্ছিল, তিনি নিজেই কথায় প্রসঙ্গ তুললেন যে, “সেদিন আমি মেরেছি, আর তারপর থেকে বহুবার তওবা করেছি”।
তো ঐটা আমাদের চাওয়ার বিষয়, আমার মনের ভিতর যদি তার ব্যাপারে রাগ আর আক্ষেপ আর প্রতিশোধের জযবা থাকে, তো ঐটার আছর তার উপরও পড়তে পারে। কিন্তু আমি যদি তার প্রতি মোহাব্বত রাখতে পারি, খায়ের খাহি রাখতে পারি আল্লাহ তা’আলা তাকে তওবার তৌফিক দেবেন। যদি সে তওবা করে তাহলে তারও ফায়দা হল, আমারও ফায়দা হল। যদি না করে তবে সেও ক্ষতিগ্রস্থ হল, আমিও ক্ষতিগ্রস্থ হলাম। তো দা‘ঈ; তার উপর যার কাছ থেকে কষ্ট আসে তার জন্য সে দু’আ করে, খায়ের খা, শুভকামী থাকে। কষ্ট আসলে কষ্ট তো লাগবেই, কিন্তু ঐটার কারনে প্রতিশোধ নেয় না।
প্রসবের সময়, সন্তান জন্মের সময় মায়ের খুব কষ্ট হয়। বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই যে ছেলে মা কে বেশী কষ্ট দিয়েছে মায়ের ভালবাসা তার প্রতি অন্যদের চেয়ে বেশী। আর গল্প করে ওর সব দুষ্টামীর, কিরকম জ্বালিয়েছে। প্রসবের কষ্ট তো বাচ্চার নিজের করা নয়, কিন্তু সেখানেও যে বাচ্চার জন্মের সময় প্রসবের কষ্ট বেশী, সাধারণত তার প্রতি মোহাব্বতও বেশী। আর কখনো এরকম শোনা যায় নি যে, “এ বাচ্চার জন্মের সময় বড় কষ্ট হয়েছে, আমি একদিন না একদিন এর বদলা নেব, আমিও ছাড়ব না ইনশাআল্লাহ”! শুনেছ নাকি কখনো? আবার হাত তুলে দু’আ করে, “হে আল্লাহ, আমি পারি না, তুমি বদলা নাও”! বরং এটা মোহাব্বতের কারন হয়। আর সাহাবারা এটাকে নিজ আগ্রহে প্রকাশ করতেন। ইকরিমা রাযিআল্লাহু আনহু মক্কা বিজয়ের পরে মুসলমান হলেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জাহেরিভাবে তাকে দাওয়াতও দেন নি, কিছুই করেন নি। ভিতরে ঐটাতো আছেই, কিন্তু প্রকাশ্যে দাওয়াত দেন নি যে মুসলমান হয়ে যাও। মুসলমান হওয়ার পরে ইকরিমা রাযিআল্লাহু আনহু নিজে থেকেই বললেন যে, ইসলামের বিরুদ্ধে আমি যা কিছু করেছি তার দ্বিগুণ আমি এর জন্যে করবো। আর করলেনও, ইসলামের বিরুদ্ধে অনেক কিছু করেছেন কিন্তু জান তো দেন নি। কিন্তু জিহাদের ময়দানে শহীদ হলেন বংশ সহ।
তো আল্লাহ তা’আলা আমাদের সামনে বিরাট সুযোগ করে দিয়েছেন, তাবলিগের কাজ বহুত পুরনো, আল্লাহর দেওয়া কাজ, কিন্তু এখন এই কাজ ধ্বংসের মুখে। ছোট খাট ক্ষতি হলে টিকে যায়। কারো আঙ্গুল কেটে গেল, আঙ্গুল ফেলে দিয়ে প্লাস্টার ব্যান্ডেজ ইত্যাদি করে কয়েকদিন পরে শুকিয়ে যায়, চলতে পারে। আঙ্গুল একটা নাই- তাতে জীবন অচল হয়ে যায় না। কিন্তু যদি একেবারে এই গর্দান কেটে যায়, তো বাকিটুকু আর সে বাঁচবে না, মরে যাবে। তো তাবলিগের মধ্যে বাংলাদেশের কাজ এত বড় অংশ যে, বাংলাদেশের কাজ যদি নষ্ট হয়ে যায় ঐ তাবলীগকে টিকানোই মুশকিল। এরকম নয় যে এটা আঙ্গুলের মত, ফেলে দিয়ে চলবে। বাকিটুকু নিয়ে পড়বে, আর এটা নষ্ট হয়ে যাবে। পট করে দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু ধাপে ধাপে।
এই যে ভন্ড যত পীর আছে, দেওয়ান বাগ আর কুতুববাগ আর মাইজভান্ডারী ইত্যাদি, যদি একটু পেছনে যাওয়া যায় তো দেখা যাবে এই সবগুলো শুদ্ধ আল্লাহওয়ালাদের তরিকা। মুত্তাক্বী, পরহেযগার, শরীয়তের পাবন্দ সব। কিন্তু কিছুদিন পরেই আস্তে আস্তে দুনিয়ার চক্করের মধ্যে পড়ে তাদের’ই বংশধর, কিছু কছু নকল বংশধরও আছে কিন্তু সব নয়, কিছু শুদ্ধ বংশধরও আছে, তাদের’ই বংশধর কিন্তু দ্বীনকে নানানভাবে বিক্রি করে এখন খাচ্ছে। এখন এমন অবস্থায় চলে এসেছে, এখন যদি কেউ চায় যে কুতুববাগকে আবার আগের অবস্থায় নিয়ে আসবে; তো ঐটা সম্ভব নয়। প্রথমেই যদি ধরা যেত তখন হয়তোবা সম্ভব ছিল।
একসময় চিশ্তিয়া তরীকা খুব বিদ’আতের মধ্যে চলে গেল। হযরত রশীদ আহমাদ গঙ্গোহী রহমাতুল্লাহি আলাইহির এই চিশতিয়া তরীকার উপর বহুত বড় অবদান, সম্পূর্ণ তরীকাকে উনি বিদ’আত থেকে শরীয়তের উপর এনেছেন। এক হল যে, একটা মেহনত থেকে আমি উপকৃত হলাম। আর আরেক হল যে, সম্পূর্ণ মেহনতটাকেই আমি রক্ষা করলাম। মাদ্রাসায় আমি পড়লাম; আমি আলিম হয়ে গেলাম, কোন কারনে মাদ্রাসা নষ্ট হয়ে গেল, আমি কী করতে পারবো? আমি মাদ্রাসাকেও রক্ষা করবো।
চিশতিয়া তরীকার দ্বারা বহু মানুষ উপকৃত হয়েছে, কিন্তু তরীকা নিজেই যখন আক্রান্ত তখন ঐ তরীকাকে সামলাবার কাজ- ঐটা সবার। গঙ্গোহী রহমাতুল্লাহি আলাইহি সেটাই করেছেন, তরীকাকে সামলিয়েছেন যাতে বিদ’আতে না পড়ে।
তো আল্লাহ তা’আলা বড় মেহেরবানি করে আমাদেরকে দ্বীন এবং দ্বীনের একটা মেহনত দিয়েছেন, একটা সুযোগ দিয়েছেন যে সুযোগ বড় বিরল। তাবলীগের মধ্যে বা দ্বীনের মেহনতের মধ্যে, আল্লাহর পথে বের হবে আর তাকে মারবে- এটাতো কেউ কোনদিন কল্পনা’ই করতে পারতো না, কিন্তু হচ্ছে। এটাকে আল্লাহর পক্ষ থেকে সুযোগ হিসেবে গ্রহন করা, আল্লাহ যদি আমাকে এই কাজকে রক্ষা করার জন্যে নির্বাচন করেন, তো এর চেয়ে বড় সৌভাগ্য আর কী হতে পারে! এজন্য বহুত আগ্রহের সাথে করা। সাময়িকভাবে খারাপ লাগবে। প্রসবের সময় যখন মায়ের কষ্ট হয় তখন কষ্ট ঠিকই লাগে, কিন্তু ঐটা তার জাহেরী কষ্ট, মনের কষ্ট নয় শরীরের কষ্ট। মনের কষ্ট এই অর্থে নয় কারন সে তো সন্তান চায়। যদি মন না চাইতো তাহলে তো সে সন্তান চাইতোই না, সন্তান সে চায়। আর যখন সন্তান সে চেয়েছে; সে জানে যে প্রসব বেদনা হবে, জেনেই চেয়েছে। তার মানে এই বেদনাটাকেও তার পরোক্ষভাবে চাওয়া। মনের দিক থেকে এটা তার জন্যে আনন্দের জিনিস, শরীরের কষ্ট হচ্ছে প্রসবের সময়। তো ওরকম মসজিদ থেকে বের করে দেয় ইত্যাদি সাময়িক ভাবে একটা কষ্ট লাগে, কিন্তু ঐ কষ্ট তো জেনে-শুনেই আসা। বাইরে থেকে যারা এসেছি, তো এই আশার উপরই তো আসা যে ওখানে কিছু পাবো ইনশাআল্লাহ।
ঈদের পরে যখন আমাদের জামাত বের হল, তো একটা জামাত এদিকে এলো (ভিক্টোরিয়া পার্ক মসজিদ, পুরান ঢাকা), ওদের জন্য তো গরম গরম ‘নাস্তা’(!) ছিল! আরেক জামাত কলাবাগান গেল, ওখানে নিরাপদ জায়গা, কিছু এস্তেকবালও করেছে। ১দিন চলে গেল, ২য় দিন সকালে জামাতের জিম্মাদার আমার কাছে ফোন করলো। ফোন করে বলল, “স্যার এখানে তো কিছু নাই, আমরা অন্য কোথাও যাই”। মন টিকছে না। ঐ জামাতের নুসরতে সে গেল (একজনকে দেখিয়ে)। গিয়ে একদিন রাতে থাকার পরে কোন পরামর্শ ছাড়াই অন্য জামাতে চলে গেল। কী হয়েছে? ‘ওখানে কিছু নাই’!
জাহেরি ভাবে কষ্টের জিনিস- কোন সন্দেহ নাই। আমি নিজেও তার ভিতর দিয়ে গিয়েছি, কষ্ট লাগে। আমাকে শারীরিক ভাবে মারে নি কিন্তু ধাক্কা দিয়েছে, নামাজের ভেতর ধাক্কা দিয়েছে। তো আমার এই বয়সে লোকের হাতে ধাক্কা খাওয়া…। কিন্তু আল্লাহ যদি কবুল করেন, এইটাই হয়তো আমার সম্বল হতে পারে, নাজাতের কারন হতে পারে।
তো এজন্য আল্লাহর কাছ থেকে আশা করে আল্লাহর পথে বের হওয়া। ইচ্ছা করে আমি চাইবো না যে মুসীবত, পেরেশানি আসুক। এটা শরীয়তের নিয়ম নয় কষ্টের জন্য দু’আ করা, কিন্তু ঐ কাজ করা যে কাজে মুসীবত আসতে পারে সেটা। এই কাজ করলে মুসীবত আসতে পারে। মুসীবত চাইবো- এটা শরিয়তের নিয়ম নয়, বরং নিয়ম হচ্ছে আফিয়াতের দু’আ করা। যদিও আমরা মনে করি যে আফিয়াতের দু’আ বলতে এটাই বুঝায় যে, এই হাদিস, ‘আফিয়াতের দু’আ কর’ আর সা’দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস রাযিআল্লাহু আনহু আর আব্দুল্লাহ ইবনে জাহশ রাযিআল্লাহু আনহুর দু’আর দিকে যদি তাকাই, তাহলে আফিয়াত কী- তা বুঝাও তো মুশকিল! আর তাঁরা যে আফিয়াত বুঝেন নি- তাও তো নয়। এজন্য আগ্রহ করা যে, হে আল্লাহ, তুমি আমাকে তোমার দ্বীনের জন্য কবুল কর। ঠিক আছে না ভাই ইনশাআল্লাহ! আল্লাহ তা’আলা আমাদের সবাইকে কবুল করুন। এজন্য খুব আগ্রহের সাথে মেহনত করব, অল্প সময়, কার কত সময় আছে আমরা জানি না।
سُبْحَانَ اللهِ وَبِحَمْدِه
سُبْحَانَكَ اللّٰهُمَّ وَ بِحَمْدِكَ اَشْهَدُ اَنْ لَّا اِلٰهَ اِلَّا اَنْتَ اَسْتَغْفِرُكَ وَ اَتُوْبُ اِلَيْكَ
سُبْحَانَ رَبِّكَ رَبِّ الْعِزَّةِ عَمَّا يَصِفُوْنَ وَ سَلَامٌ عَلٰى الْمُرْسَلِيْنَ وَ الْحَمْدُ لِلّٰهِ رَبِّ الْعَالَمِيْنَ