শুক্রবার, এপ্রিল ১৮

يَخْتَصُّ بِرَحْمَتِهِ مَن يَشَاء (3-74)

“আল্লাহর রহমত দিয়ে যাকে চান তাকে নির্বাচন করেন,”

يَجْتَبِي إِلَيْهِ مَن يَشَاء وَيَهْدِي إِلَيْهِ مَن يُنِيبُ* اللَّهُ (42-13)

“যাকে চান তাকে নিজের জন্যে নির্বাচন করে নেন, আর যে প্রত্যাবর্তন করে তাকে পথ দেখান।”

প্রথমত ঈমান পাওয়াই একটা নির্বাচন, নামাজ-রোযা করতে পারা এগুলো নির্বাচন। দাওয়াত এর কাজে শরীক হতে পারা একটা নির্বাচন, এগুলো আল্লাহ্ তায়ালার এহসান। এই সব কিছুর পরে যে কোন জমানায় দ্বীনের কাজের হেফাজতের জন্যে কাউকে নেওয়া, এটা আল্লাহ্ তায়ালার তরফ থেকে একটা বহুত বড়, খুবই বিশিষ্ট ধরনের নির্বাচন। আল্লাহ্ তায়ালা বিভিন্ন জমানায় বড় সংকটের সময় তাঁর খাস বান্দাদেরকে দ্বীনের হেফাজতের জন্যে নির্বাচন করেছেন।

রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ওফাতের পর গোটা উম্মত যখন বিভ্রান্ত, তখন আবু বকর সিদ্দীক রাযিআল্লাহু তায়ালা আনহু এসে সবাইকে শান্ত করেছেন। আল্লাহ্ তায়ালা তাঁকেই ব্যবহার করেছেন এই বিভ্রান্তির সময় উম্মতকে শুদ্ধ পথ দেখাবার জন্য। এরপরই শুরু হলো ইরতেদাত যাকাত নিয়ে; যে আমরা যাকাত দিব না। এটা একটা হুকুমের অস্বীকার ছিল, একটা হুকুম পালনে অপারগতা নয়। যাকাত যদি কেউ না দেয় (এ যমানায় বহুত মুসলমান যাকাত দেয় না), কোন মুফতি তার উপর মুরতাদের ফতওয়া দেবে না। ওখানেও আবার আল্লাহ্ তায়ালা আবু বকর সিদ্দীক রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু কে ব্যবহার করেছেন, দ্বীনের হেফাজতের জন্য। আর তখন এই আবু বকর সিদ্দীক রাযিআল্লাহু তায়ালা আনহুর বহুত মশহুর কথা ছিল,

“আ ইয়ানকুসুদ্দীন ওয়াআনা হাই”                                            “দ্বীনের ক্ষতি হবে, আর আমি জীবিত ?”

নিজের জীবন দিয়েছেন দ্বীন রক্ষা করার জন্য। সংকটের সময় আল্লাহ্ তায়ালা তাঁর বান্দাদেরকে ব্যবহার করেছেন; এক এক সময় এক এক জনকে। কা’দিসিয়ার যুদ্ধের সময়ে মুসলমানদের পরাজয়ের অবস্থাকে বিজয়ে পরিবর্তিত করার জন্য ব্যবহার করলেন আবু মাহ্জান সাকাফী রাযিআল্লাহু তায়ালা আনহু কে। উনি মদ পান করতেন আর জিহাদের ময়দানে ছিলেনও না। কিন্তু আল্লাহ্ তায়ালা তাঁকেই বেছে নিলেন। উনি গিয়ে ময়দানের মধ্যে ঢুকে এমন হিম্মত দিলেন যে, গোটা ময়দানের অবস্থার পরিবর্তন হয়ে গেল। এটা আল্লাহ্র তরফ থেকে একটা নির্বাচন। বিভিন্ন যমানায় আল্লাহ্ তায়ালা তাঁর প্রিয় বান্দাদেরকে দ্বীনের হেফাজতের জন্য নির্বাচন করেছেন। কোরআন শরীফ সংকলনের জন্য ওমর রাযিআল্লাহু তায়ালা আনহু কে আল্লাহ্ তায়ালা নির্বাচন করলেন, উনি প্রস্তাব দিলেন কোরআন শরীফ সংকলন করা হোক। এর পরবর্তী কালে দ্বীনের ময়দানে বহুত বড় অবদান মাওলানা ইলিয়াস রহমাতুল্লাহি আলাইহি এর, এটাও দ্বীনের হেফাজতের জন্যই আল্লাহ্র পক্ষ থেকে নির্বাচন। সমসাময়িক আল্লাহ্ ওয়ালাদের মধ্য থেকে আল্লাহ্ তাআ’লা এই বিশেষ মর্যাদার জন্য হযরত মাওলানা ইলিয়াস রহমাতল্লাহি আলাইহি কেই নির্বাচন করেছেন।এই বহুত বড় মেহনত বিরাট সংকটের মধ্যে পড়ে গেছে, যে সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা সবাই এখানে একত্রিত। এটা শুধু একজন মানুষের কিছু অপকর্ম নয়, সম্পূর্ণ কাজ ধ্বংসের পথে। একজন মানুষের অপকর্ম যদি হতো, তা আমাদের অত মাথা ঘামানোর ব্যপার ছিল না; কিন্তু সম্পূর্ণ কাজ নষ্ট হওয়ার পথে।

আর বাংলাদেশের কাজ নষ্ট হয়ে গেলে, বাকি তবলীগও দুনিয়াতে টিকে থাকা মুশকিল হবে। কারণ দ্বীন একটা জীবন্ত জিনিষ, আর জীবন্ত জিনিষের বড় অংশ না থাকলে বাকী অংশ টিকে না। বাংলাদেশের তবলীগ বলা যেতে পারে যে, সম্পূর্ণ আলমী তবলীগের এক তৃতীয়াংশ, সংখ্যা ইত্যাদির দিক থেকে। আর কোন কোন দিক থেকে আরও বড়। টঙ্গি ইজতেমার সময় পুরা দুনিয়ার মাশওয়ারা এখানেই হয়। আল্লাহ্ তায়ালা এমন কিছু অবস্থা সৃষ্টি করেছেন যে, অন্য কোন দেশে দুনিয়ার সবার আসা মুশকিল; একত্রিত হতে পারে না। বাংলাদেশে প্রায় সব জায়গা থেকে আসতে পারে। এই সুবিধা থাকার কারণে প্রধান আলমী মাশওয়ারা গুলো বাংলাদেশেই হয়। তাই বাংলাদেশের তবলীগের সংরক্ষন বা হেফাজত আসলে আলমী তবলীগের হেফাজত। এতবড় কাজ আর আল্লাহ্ তায়ালা নির্বাচন করেছেন আমাদের মত নগন্য মানুষকে। সমস্যাতো অনেক দিনের; কিন্তু সমাধানের জন্য কেউ এগিয়ে আসেননি। আমাদের এগিয়ে আসা, আল্লাহর পক্ষ থেকে আমাদের জন্য অনেক বড় সুযোগ।

আবু মাহ্জান সাকাফী রাযিআল্লাহু তায়ালা আনহু; এত জন বড় বড় সাহাবী থাকতে আল্লাহ্ তায়ালা নির্বাচন করলেন তাঁকেই, যিনি মদ পান করতেন। আর তাঁকে দিয়েই আল্লাহ্ তায়ালা এতবড় কাজ করালেন। আর এই কাজের উসিলায় আল্লাহ্ তাঁকে এ খারাপ অভ্যাস থেকে তওবাও নসীব করলেন।

আল্লাহর কাছে শুকর আদায় করা যে, আল্লাহ্ তায়ালা মেহেরবাণী করে আমাকে এই বড় কাজের জন্য পছন্দ করেছেন; আর যখন করেছেন, পু্রো গুরুত্ব ও আদবের সাথে তার হক্ক আদায় করার চেষ্টা করা উচিত। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দেহ মোবারককে যখন কিছু খ্রীষ্টানরা নিয়ে যেতে চাইল, তখন আল্লাহ্ তায়ালা তাঁর হেফাজতের জন্য ব্যবহার করলেন নূরউদ্দীন জঙ্গী রহমাতুল্লাহি আলাইহি কে, অথচ উনি মদিনায় ছিলেনও না, মদিনায় আরও অনেক আল্লাহ্ ওয়ালারা ছিলেন, কিন্তু আল্লাহ্ তায়ালা মিশর থেকে উনাকে আনিয়ে হেফাজত করালেন। যখন করালেন উনি তার খুব কদর করলেন, খুব যত্নের সাথে করলেন, যারা এ অপকর্ম করতে চাচ্ছিলো, তাদের কতল অন্য কাউকে দিয়ে না করিয়ে নিজ হাতে করলেন। আদবের দাবী এটাই। খিদমত যেন নিজ হাতেই করে।

আল্লাহ তায়ালা মেহেরবানী করে আমাদেরকে এত বড় কাজের জন্যে নির্বাচন করেছেন। এর পুরা হক আদায় করবার চেষ্টা করা। দিল থেকে আল্লাহর কাছে শুকুর আদায় করা ও কদর করতে পারার তৌফিক চাওয়া ও কবুলিয়াতের জন্যে দোয়া করা। যদি এ দায়িত্বকে ঠিকমত আদবের সাথে আদায় করতে পারি, হয়তঃ এটাই আমার নাযাতের উসিলা হবে। হয়ত এ দায়িত্ব পালনই তরক্কীর উসিলা হবে। যেরকম মানুষ যিকির করে তরক্কী করে, গাশত্ করে তরক্কী করে, তালীমের মাধ্যমে তরক্কী করে বিভিন্ন ভাবে তার রুহানী তরক্কী হয়।

সাহাবাদের তা’লিম, তরবিয়ত ও তরক্কীর বড় অংশই হয়েছে সংকটের মোকাবেলার মাধ্যমে। গাল শোনা, মার খাওয়া সহ্য করার মাধ্যমে। আমাদের এই যমানায় মানুষ দ্বীনের মেহনত করবে, আর এ জন্য তাকে একটা চড় খেতে হবে বা গাল শুনতে হবে, এটা কোন ধারনার মধ্যেই ছিল না, কোন সুযোগই নাই। আল্লাহ তায়ালা সে সুযোগও করে দিয়েছেন। দ্বীনের মেহনতের মধ্যে মোকাবেলার সম্মুখীন হওয়া, এটাকে কদর করা, আর কদর আগ্রহের সাথে করা। কবি লবীদের কবিতার বিরুদ্ধে বলার কারণে উসমান ইবনে মাদঊন রাযিআল্লাহু তায়ালা আনহু কে উবাই বিন খলফ ঘুষি মারল। ঘুষি খেয়ে রক্ত জমে চোখ নীল হয়ে গেল। তাঁর চাচা বললেন যে “আমার আশ্রয়ে থাকলে তোমার এই অবস্থা হত না”। উনি বললেন, “আমার অপর চোখও এটারই আগ্রহী।” ইচ্ছা করে ঐ আশ্রয়কে বাদ দিয়েছেন যাতে মার খান। কারণ আশ্রয়ে থাকার কারণে উনি নিরাপদ, আর বাকি সবাই মার খাচ্ছেন। এই নিরাপদ থাকাই তাঁর কাছে ভাল লাগে নি। ঐ আশ্রয় প্রত্যাখ্যান করলেন মার খাওয়ার জন্যে। আমি বঞ্চিত থাকব কেন? দুনিয়ার মানুষ যেরকম মনে করে, আমার ভাগ পাব না কেন? সবাইকে দিচ্ছে, আমাকে দেবে না কেন? উনি ওরকমই ভাবলেন, সবাই মার খাচ্ছে, আমি খাব না কেন? আমারও হক্ব আছে। নিজে হক্ব নেওয়ার জন্য চাচার আশ্রয়কে উনি পরিত্যাগ করলেন। প্রথমে একাকি, তারপর বাজারে গিয়ে প্রকাশ্যে, যেন সবাই জানে যে আমি এখন উন্মুক্ত, আমি এখন মার খেতে পারি। যে কেউ যেন আমার উপর হাত তুলতে সাহস পায়। ঠিকই মার খেলেন, আর উনি তার কদর করলেন।

আল্লাহ্ তায়ালা আমাদের কে দ্বীনের কদর করার তৌফিক নসীব করুক। আমীন.

سُبْحَانَ اللّهِ وَ بِحَمْدِهَ سُبْحَانَكَ اللَّهُمَّ وَبِحَمْدِكَ أَشْهَدُ أَنْ لَا إِلَهَ إِلَّا أَنْتَ أَسْتَغْفِرُكَ وَأَتُوبُ إِلَيْك  سُبْحَانَ رَبِّكَ رَبِّ الْعِزَّةِ عَمَّا يَصِفُون وَسَلَامٌ عَلَى الْمُرْسَلِينَ وَالْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينََ

Leave A Reply