সোমবার, এপ্রিল ১৪

১৯৯৫ এর শীতের সময় ফজরের নামাজের পরে আমাদের মসজিদের মাশওয়ারা তে প্রফেসর সানাউল্লাহ সাহেবের সাথে সাদা জুব্বা, ফুল সোয়েটার ও মাথায় সাদা আমামা পরিহিত এক বুজুর্গকে দেখলাম। মাশওয়ারা শেষে সবার সাথে মুসাফা করলেন কিন্তু উনার পরিচয় জানতে পারলাম না। সেদিন দ্বিতীয় গাশ্ত ছিল একটা আবাদির ছোট্ট মসজিদে, দেখলাম উনিও এসেছেন।

সেখানে প্রথম পরিচয় হলো আমি বাঙালি শুনে খুব খুশি হলেন ও আমার সাথে কিছু আলাপ পরিচয় করলেন। বাদ-মাগরীব উনি উর্দুতে বয়ান করলেন, শুরুতে মনে হলো উনি তাবলীগের সাথী নন কারণ আমাদের বয়ান সাধারণত যে ভাবে শুরু হয় তার থেকে একেবারে ভিন্ন রকম ছিল। কতগুলো মনে না থাকলেও খুব ভালো লাগছিলো আর ভাবছিলাম উনি তাশকিল করবেন কি ভাবে।

অল্প সময়ের বয়ানে একেবারে অনাবিদ্দ ছন্দে উনি দ্বীনের মেহনত বোঝালেন ও তাশকিল ও করলেন। আমি অবাক।

ডক্টর সানাউল্লাহ সাহেবের মেহমান আসলে তাঁদের থাকার ব্যবস্থা মাদ্রাসার মেহমানখানাতে রাখা হয়। এই প্রথম দেখলাম এক অনাত্মীয় সানাউল্লাহ সাহেবের বাড়িতে অবস্থান করছেন এমনটা আজ অব্দি এখনও দেখিনি।

আমি মুস্তাফা কামাল, পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ থেকে আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্দালয়ে পড়তে এসেছিলাম ১৯৯০ এ B. Sc. (Hons.)। যদিও এখানে আসার পূর্বেই তাবলীগে চিল্লা দেওয়া হয়েছিল কিন্তু এই কাজকে শেখার সঠিক বয়সে আলীগড়ে পড়তে চলে এসেছিলাম বলে তখন থেকে আজও শেখার সুযোগ পাচ্ছি। প্রফেসর সানাউল্লাহ সাহেবের কম্পিউটার ইনস্টিটিউট এ কম্পিউটার Programming শিখি ১৯৯৫-৯৬ এর দিকে। তারপরে সেই ইনস্টিটিউট এ ছাত্রদের কম্পিউটার ট্রেনিং দিই এবং পরবর্তী সময়ে ডক্টর সানুল্লাহ সাহেবের স্কুল, মাদ্রাসাতে কম্পিউটার ও অঙ্কের শিক্ষক হিসেবে চাকরি করি প্রায় ১২ বছর। ২০১০ থেকে আলীগড় মুসলীম বিশ্ববিদ্দালয়ে সিনিয়র টেকনিক্যাল কম্পিউটার অ্যাসিস্ট্যান্ট এর পোস্টে আছি।

যাইহোক ১৯৯৬ এ প্রফেসর মুশফিক সাহেব (রহঃ) আর একবার এসেছিলেন আলীগড় এবং এইবার উনার বয়ান হয় আলীগড় এ শবগুজারিতে এবং ইউনিভার্সিটি জামে মসজিদে বিখ্যাত Sunday ইজতিমাতে। আসলে নিজামুদ্দিন এ বাংলাদেশের জোড় এ উনি আসতেন সেখান থেকে সানাউল্লাহ সাহেবের সাথে আলীগড় চলে আসতেন। ভালোভাবে জানার ও বোঝার এবং উনার কাছ থেকে ফ্রান্সের কিছু সুযোগ হয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০৩ এ আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্দালয় থেকে চার মাসের জামাতে আমার যাওয়া হয় বাংলাদেশে। ডক্টর মুশফিক সাহেব (রহঃ) নিজে তাকাজা রেখেছিলেন সেই জামাতের রোখ এক মাসের জন্য রাজশাহীতে যেন দেওয়া হোক। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের হোস্টেলের মসজিদগুলোতে জামাত থাকাকালীন উনি সামানসহ আমাদের জামাতের সাথে ছিলেন। উনার উপস্থিতিটির কারণে আমরা আমলের সময়ে খুব সতর্ক থাকতাম কারণ উনি তালিমের সঠিক সময়ে ওযু ও নফল সেরে বসে পড়তেন।

নিজের থেকে কিছুই বলতেন না এবং এতো বেশি চুপচাপ থাকতেন আমরা ভাবতাম কিছু টেনশন এ আছেন হয়তো। কিন্তু ছাত্রদের কাছে জানলাম উনি প্রায় এরকম চুপচাপ থাকেন এবং আমাদের বয়ান তর্জুমা করতেন নিজে বয়ান করতে রাজি হতেন না বা এই বলে কাটিয়ে দিতেন এখানকার ছাত্ররা উর্দুতে বয়ান শোনার আগ্রহী হয়ে আছে পরে আমরা কাজের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করতে শুরু করলাম আর উনি সংক্ষিপ্ত উত্তর দিতেন, তাতে আমাদের সন্তুষ্টি পুরাতো না।

একদিন আমাদের আমির সাহেব বললেন আপনি কিছু বক্তব্য রাখুন আমাদের জামাতের সাথীদের কাছে, তাতেও সহজে রাজি হলেন না বললেন

“আমি আমার বন্ধুর কাছে শিখা পুরানো সবক আবার স্মরণ করার জন্য আলিগড়ের ডক্টর সানাউল্লাহর জামাতের সাথে জুড়েছি”।

অনেক অনুরোধ করার পরে শেষের দিকে উনি রাজি হলেন। কিছু কথা মনে আছে। শুরু করেছিলেন এই ভাবে

“আম্বিয়া (আ) আপনি উম্মত কো দাওয়াত দেতে থে দালায়েল কে সাথ নেহি, বাল্কি মুহাব্বাত কে সাথ। দ্বীন পর মজবুতি লানে কে লিয়ে ফাজায়েল কে সাথ দালায়েল পেশ করতে থে। হর নবি কো আপনি উম্মত সে আশদ মুহাব্বাত হোতি থি জিস কো আল্লাহ সুবনাহু তায়ালা কুরআন মে বয়ান কিয়া। লোগো কো আপনি আওয়াদ সে জিতনি মুহাব্বাত হোতি উসসে কাঁহি জয়াদা মুহাব্বাত নবি কো আপনি উম্মত সে হোতি থি। আওয়াম দালায়েল সে নেহি, মুহাব্বাত সে করীব আয়েগী।……”

অনুবাদঃ “আম্বিয়া (আ) নিজের উম্মতকে দাওয়াত দিতেন দলিলের সাথে নয় , বরং মুহাব্বতের সহিত। দ্বীনের উপর মজবুতি আনয়ন আনার জন্য ফাযায়েলের সহিত দলিল পেশ করতেন। নিজের উম্মতের সহিত সমস্ত নবীর অস্বাভাবিক মুহাব্বাত হতো যেটা আল্লাহ সুবনাহু তায়ালা কুরআন এ বর্ণনা করেছেন। লোকেদের নিজের আওলাদের প্রতি যে মুহাব্বাত হয় তার থেকে অনেক বেশি মুহাব্বাত উম্মতের প্রতি নবীদের হতো। আওয়াম (জনসাধারণ ) দলিলের দ্বারা নয়, মুহাব্বতের দ্বারা কাছে আসবে।”

তারপরে উনি একটা কারগুজারি শোনালেন। সেই কারগুজারির বাংলা করছিঃ

“ফ্রান্স এ থাকাকালীন এদিকে ওদিকে সাক্ষাতের প্রচুর তাকাজা আসতেই থাকে। তখন খুব প্রয়োজন দেখা দিলো একটা ব্যাক্তিগত চার চাকার গাড়ি থাকা দরকার। ওখানে তখন সুদ ছাড়া কিস্তিতে গাড়ি কেনা পাওয়া যেতো। আমি প্রয়োজনের তাকিদে তিন কিস্তিতে গাড়ি কিনে ফেললাম, সেই গাড়ি আমাদের খুব কাজে আসলো। দুই কিস্তি দেওয়ার পরে তৃতীয় কিস্তি দেওয়ার পয়সা আমি জোগাড় করতে পারলাম না। কিস্তি জমা করার লাস্ট ডেট কাছাকাছি চলে আসায় খুব চিন্তিত হয়ে পড়লাম গাড়ি হাত ছাড়া হয়ে যাবে বলে। সানাউল্লাহ এই কথা জানতো না যে গাড়িটা কিস্তিতে কিনেছি। আমায় চিন্তিত দেখে সানাউল্লাহ বারবার জিজ্ঞেস করে কারণ কি, শেষে তাকে সব বললাম। শুনে আমার থেকে অনেক বেশি সানাউল্লাহ চিন্তিত হয়ে পড়লো। তাকে চিন্তিত দেখে আমাদের এক আরব বন্ধু যে খুব সাক্ষাৎ করাতো সে তার চিন্তার কারণ জানতে চাই। তাকেও বলতে বলতে। তখন আর কি পরের দিনেই এক আরব আর এক ফ্রান্সের বন্ধু মাইল তৃতীয় কিস্তি আদায় করে দেয় আর খুব খুশিও হয় তারা এই কারণে যে তারা আমাদের কোনো কাজে আস্তে পেরে। সেই কিস্তির পয়সা পরবর্তীতে অনেক অনুরোধ সত্ত্বেও তারা ফিরিয়ে নেয়নি। এক দায়ী অন্য দায়ীর চিন্তাকে নিজের চিন্তা বানিয়ে নেয়। আপোষের মধ্যে এতো বেশি মুহাব্বাত পয়দা হয়, বা বলতে পারি অবশ্যই হওয়া উচিত।

সেই গাড়ির আর দুটো কারগুজারি আপনাদের শোনাই। ..

সেই গাড়িতে দাওয়াতের কাজের তাকাজাতে দুইজন সাথীকে আলজিরিয়া পর্যন্ত পোহচানোর জন্য আমি সানাউল্লাহ ভাইয়ের সাথে যাচ্ছিলাম। তখনও পর্যন্ত ড্রাইভিং লাইসেন্স আমি পাইনি, কিন্তু সানাউল্লাহর কাছে তাঁর লাইসেন্স ছিল, এইজন্য সেই ড্রাইভিং করছিলো। দুইদিকে নিরিবিলি জনহীন সবুজ ঘাসের ম্যাথ আর সোজা রাস্তা দিয়ে গাড়ি চলার সময় পিছনে বসা সাথীরা ঘুমিয়ে যাই কিছুক্ষন পরে কখন আমার ও সানাউল্লাহর ঘুম এসে যাই বুঝতে পারিনি। গাড়ি রেস্ট থেকে নেমে ঢাল ধরে যখন উঁচুনিচু মাঠে নেমে যাই তখন ঘুমভেঙ্গে দেখি সামনে একটা গাছের সামনে গাড়ি জোরে ধাক্কা খাবে। সঠিক সময়ে সানাউল্লাহ ব্রেক চেপে গাড়ি থামায়। সে এতো বেশি ঘাবড়িয়ে যাই যে পরে সমস্ত রাস্তা ও ফেরার সময় আমাকে গাড়ি চালাতে বলে। সিদ্ধান্ত নিলাম, পুলিশ লাইসেন্স দেখতে চাইলে বলা হবে ড্রাইভার এর শরীর খারাপ। ভাই সানাউল্লাহ দেড় বছর পরে পি এইচ ডি শেষ করে দেশে ফিরে গেলো। আমি তাকে ছেড়ে অত্তান্ত বিচলিত হয়ে পড়েছিলাম কিন্তু দাওয়াতের কাজের অনেক সাথী তখন প্যারিস ও অন্যান্য স্থানে আমাদের সাথে জুড়তে শুরু করে, তাতে খুব ব্যাস্ততা বেড়ে যাই । ইন্ডিয়া, আলজিরিয়া, জার্মানি ও পাকিস্তান থেকে জামাত আসা যাওয়া শুরু হয়ে যাই। ইন্ডিয়া থেকে একটা জামাত আসে, যে জামাতে ভাই সানাউল্লার আব্বাও ছিলেন। এ সময় আমি জোশে সিদ্ধান্ত নিলাম প্যারিস থেকে ড্রাইভ করে আলীগড় পর্যন্ত গিয়ে ভাই সানাউল্লাহকে সেই গাড়ি উপহার দিবো এবং বেরিয়ে পড়লাম। প্যারিস থেকে বেলজিয়াম, জার্মানি, পোল্যান্ড, তুর্কি ইত্যাদি হয়ে আফগানিস্তান পর্যন্ত পোহচে যায় কিন্তু আফগান পাকিস্তান বর্ডারে আমাকে আগে যেতে দেওয়া হয়নি সেই কারণে সেই গাড়িটা আফগানিস্তানে বিক্রি করে দিই। পরে by flight এ দিল্লি হয়ে আলীগড় যাই।”

প্রফেসর মুশফিক সাহেব (রহঃ) যখন আমাদের সাথির বয়ান উর্দু থেকে বাংলায় তর্জুমা করতেন তখন দেখতাম উনি সামান্য কথা নিজের থেকে অ্যাড করতেন না। কিন্তু আমি তর্জুমা করার সময়, প্রয়োজন বোধে অ্যাড করতাম। উনার কাছে শিখেছি তজুমার সময় আমানতদারী কাকে বলে। আমি উনার থেকে বেশি চুপ থাকা ব্যক্তি জীবনে দেখিনি। তাহাজ্জুদের সময় এতো শান্তভাবে ধীরে ধীরে বিছানা উঠাতেন এবং নামাজ পড়তেন যে কোনো সাথী একদম টের পেতোনা, কোনোদিন নিজের থেকে লাইট অন করতেন না। যেদিন উনার তরফ থেকে খাবার দাওয়াত হতো সেদিন মসজিদে রান্নার সময় ছাত্রদের সাথে উনি নিজেও খিদমত করতেন। কুরআন এর হালকার সময় খুব সামান্য কিছু বোঝাতেন। নিজে যখন তালিম করতেন, তখন বই এ যা লেখা আছে তা ছাড়া কিছুই বলতেন না। শুধু একবার রসিকতা মূলক একটু বলতে শুনেছি:

“আমির সাহেব আজ নিশ্চিন্তে খেতে পারবেন মাছের কোনো গন্ধ পাবেন না, কারণ আজ যে বাজার থেকে মাংস ও সবজি কেনা হয়েছে সেই বাজারে মাছ পাওয়াই যাই না।”

পরে যখন আমাদের জামাত ঢাকাতে ছিল তখন উনি এসেছিলেন কাকরাইল এ দেখা করতে আমরা জানতে পারি ঢাকাতে তিনার মেয়ের বিয়ে আজই কিন্তু উনি যেতে চাচ্ছেন না কারণ শরীয়াত সম্মত ভাবে তাঁর স্ত্রী মেয়ের বিয়ে দিচ্ছেন না। শেষে আমরা সবাই মিলে ডক্টর সাহেবকে রাজি করালাম সন্ধ্যায় শুধু রুখসতির (বিদায়ের) সময় মেয়ের মাথায় হাত রেখে দুআ দিয়ে আসুন। উনি গিয়েছিলেন, ফিরে এসে আমাদের প্রতি খুব খুশি হন।

আমি অন্তর থেকে এই দুআ করি যে আল্লাহ প্রফেসর মুশফিক (রহঃ) কে কেয়ামতের দিন তাঁর ছাত্রদের সাথে উচ্চ মর্যাদার সহিত সকলের সামনে হাজির করান, সেদিন মানুষ তাঁর আসল উচ্চতা জানতে পারবে। তিনাকে ও আমাদের সবাইকে জান্নাতুল ফিরদৌসে জায়গা দান করুন। আমীন, ইয়া রাব্বুল-আলামীন।

Leave A Reply